মা হলো মধুর ডাক
- আপডেট সময় : ০৭:৩৯:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬১ বার পড়া হয়েছে
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৩৮ পিএম
গরিলার প্রতীকী ছবিটি পেক্সেল থেকে নেওয়া
গরিলার প্রতীকী ছবিটি পেক্সেল থেকে নেওয়া
দিনটা শনিবার। ৩১ অক্টোবর ২০২১। আমেরিকাজুড়ে রোমাঞ্চকর ‘হ্যালোইন’ উদ্যাপনের দিন। শীতঋতু আগত প্রায়। কিছুদিন বাদেই শুরু হবে গৃহবন্দী জীবন। অতএব সাপ্তাহিক ছুটি উপলক্ষে জীবন উপভোগের আশায় অজস্র মানুষ আজ সপরিবারে ঘরের বাইরে।
৩৪০০ ভাইন স্ট্রিট-এর চিড়িয়াখানা বনাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধদের ভিড় জমে উঠেছে সকাল থেকে। শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হিমেল হাওয়ার পায়ে পায়ে। চারপাশের সতেজ সবুজ অনেক আগেই নিঃশেষিত। চারদিকে রাশিরাশি ঝরাপাতার উদ্বেলিত কান্না। বাতাসের বুক ছুঁয়ে সারাদিন তাদের অশ্রুপাতের ঝরঝরানি গান। বৈরাগ্যের বিবাগী পরশ আকাশজুড়ে ছড়ানো। এমন পরিবেশে কিছু একটা লুকিয়ে থাকে, ভাষার বাঁধনে যাকে ধরা যায় না। কেবলই অন্তরের অনুভবে তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মিলিয়ে যায়। চিড়িয়াখানার অ্যানিম্যাল এনকাউন্টারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে লোহার ফেঞ্চের সামনে গুচ্ছ দর্শকের ভিড় জমেছে আজ। সবারই কৌতূহলী দৃষ্টি নিচের দিকে ছড়ানো। সেই ২৪ ফুট গহীন গভীরে। যেখানে বিশাল পরিসর আর প্রাকৃতিক জঙ্গলজুড়ে গরিলাদের রমরমা রাজ্য।
দর্শকের ভিড়ের কারণ, মাসখানেক আগে এক তরুণী গরিলা চিড়িয়াখানায় প্রথমবার সন্তান প্রসব করেছে। পরম যত্নে সে তখন একখানা বিশাল পাথরের ওপর পা ছড়িয়ে বসে ঠিক মানবী মায়ের মতো স্নেহবাৎসল্যে নিমগ্ন থেকে সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিল নিবিষ্ট মনে।
বিজ্ঞান বলে, গরিলাদের গঠনবৃত্তান্ত নাকি বড় বেশি মানুষের মতো। উভয়ের জেনেটিক মেটেরিয়ালের ৯৮.৩ শতাংশই মিলে যায়। সে জন্যই তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি, ঈর্ষা-বিদ্বেষের উদ্বেলতা, আচার-আচরণ এত বেশি মানুষের কাছাকাছি।
দেখতে দেখতে হঠাৎ এক অভাবনীয় ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটে গেলো আচমকা। লোহার ফেঞ্চ ধরে ওপরে উঠতে উঠতে হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল তিন বছরের এক কচি শিশু। চারপাশের কোলাহল মুখরতা থেমে গেল মুহূর্তে। নির্বাক হয়ে গেলেন শত শত কৌতূহলী দর্শক। তাদের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ল বিস্ময়কর বেদনার মর্মাহত উচ্ছ্বাস। একই সঙ্গে এক তরুণী মানবীর কন্ঠস্বর চিরে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল অশ্রুভাঙা শব্দ– ওঃ গড! প্লিজ গিভ ব্যাক মাই বেবি! তারপরই সে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।
দর্শকেরা দেখলেন, বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো অতল গহ্বরের দিকে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে তিন বছরের ক্রিস। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে ঝরে পড়ল এক জলপ্রপাতের পাশে। আশপাশের প্রাণিগুলো অবাক বিস্ময়ে সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কৌতূহলভরে এগিয়ে এল কেউ কেউ। নিথর হওয়া শরীরটাকে বারকয়েক উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখল। কানের পাশে তুলে ধরে কিছু একটা পরখ করার চেষ্টাও করল কেউ। তারপর যথাস্থানে রেখে ঠোঁট উল্টে ভেংচি কাটল সে। হয়তো বলতে চাইলো– আর কী হবে! মরেই তো গেছে! অশ্রুর স্রোত দেখা দিল নাকি তার অনুভূতির গাঢ়তায়?
গবেষকেরা বলেন, গরিলারা কাঁদলেও চোখ অশ্রুসিক্ত হয় না মানুষের মতো। কিন্তু তাদের বিষাদযন্ত্রণার অনুভূতি তাতে একতিলও কম থাকে না। শোকতাপ, আবেগবিহ্বলতা মানব অন্তরের মতোই ছুটে বেড়ায় তাদের হৃদয়রাজ্যের অতলজুড়ে।
ততক্ষণে তরুণী মায়ের চেতনা ফিরে এসেছে এবং মানবশিশু উদ্ধারের জোর প্রচেষ্টা চলছে চিড়িয়াখানার পক্ষ থেকে। গরিলাদের মনমেজাজ যাদের দখদর্পণে, তারা জানেন, সাধারণভাবে সামাজিক জীব হিসেবে এরা শান্তিপূর্ণ হলেও বন্যপ্রাণির সহজাত প্রবণতায় সহজেই এরা প্রভাবিত হয়। তাই যে কোনো বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে এরা মুহূর্তেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। কোনো উপায়ে গরিলারাজ্য থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা যেতে পারে, নিচে নেমে তারই কৌশল খুঁজতে তখন ব্যাকুল তিনচারজন গরিলাবিশেষজ্ঞ মিলে। হঠাৎ ৭০০ পাউন্ড ওজনের এক সিলভারব্যাক অতি গম্ভীরমুখে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রাজকীয় পদক্ষেপ ফেলে।
গরিলাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনুসারে এখানকার গরিলারাজ্যের অভ্রান্ত রাজা আর শাসক সে। তার নির্দেশ সবাই নির্বিবাদে মেনে চলে। নির্বিচারে তার দাপট সমীহ করে। সিলভারব্যাক তার পেশীময় লোমশ হাতে বড় অবহেলায় এক টুকরো ঘাসের মতো ক্ষুদে মানবশিশুটিকে তুলে ধরল উঁচুতে। তার চোখের দৃষ্টিতে তখন লালচে প্রখরতা। প্রেমহীন নির্লিপ্ততার হিংস্রবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে শরীরের প্রতিটি ভাষ্যে। দর্শকেরা অনেক উঁচু থেকেও চরম আতঙ্কে দেখতে পেলেন, যদি ভাগ্যক্রমে ক্রিস তখনো বেঁচেও থাকে, তাহলেও তার অন্তিম মুহূর্তের বিন্দুমাত্র বিলম্ব নেই!
সিলভারব্যাক মানবশিশুকে ফের অবহেলায় তুলে ধরে একইভাবে অবহেলায় জলস্রোতে নামিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। অদূরে উঁচু পাথরের ওপরে বসে বসে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে অন্য গরিলাদের সব কার্যকলাপই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে দেখছিল তরুণী গরিলা। জাঁদরেল রাজার কর্মকাণ্ডও নিবিড় পর্যবেক্ষণে একইভাবে দেখতে লাগল সে। দেখতে দেখতেই সন্তানকে নামিয়ে রেখে হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসল।
গরিলারাজ মানবশিশুকে জল থেকে তুলে মাটিতে ফেলে পায়ের পাতা দিয়ে চেপে চেপে দেখল কয়েকবার। তারপর ফের নিচ থেকে তুলতে যেতেই এক লাফে নিচে নেমে তরুণী গরিলা ছুটে এসে ছিনিয়ে নিল শিশুটিকে। বুকের ভেতর পরম যত্নে চেপে ধরে ছুটতে শুরু করল সেইদিকে, যেখানে উদ্ধারকর্মীরা তখন ক্রিসকে উদ্ধার করার চতুর কৌশল খুঁজছেন। পলকের জন্য সিলভারব্যাক রুদ্ধবিস্ময়ে বিহ্বল হলো। এবং পরক্ষণেই উত্তপ্ত রাগে নিজের বুকের ওপর চাপড় মারলো কয়েকবার। অতি সাধারণ মেয়ে গরিলার এতবড় দুঃসাহস ক্ষমার অযোগ্য তার কাছে। সিলভারব্যাকের হুংকারে বজ্রনির্ঘোষ জাগতেই রাজার রজোগুণে মিশে গেলে বুনো পশুর হিংস্রতা।
এমন ঘটনার পরে গরিলাবিশেষজ্ঞরা কৌশল নিতে অপারগ। তখন চূড়ান্ত পরিস্থিতির জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে তারা বাধ্য। ওদিকে আকুল জননীর মতো ক্রিসকে বুকে চেপে তরুণী গরিলা তখন এঁকেবেঁকে ছুটেছে পাগলের মতো।